বিপন্ন পর্যটন নগরী: লাখো পর্যটকের নিরাপত্তা শুধু লাল পতাকায়

সমকাল •

সাগর সৈকতকে পর্যটনবান্ধব করতে হলে সবার আগে প্রয়োজন এর নিরাপত্তা। অথচ, এক দশক ধরে ভাটার সময় কেবল লাল পতাকা উড়িয়ে কক্সবাজার সৈকতে চলছে হাজারো পর্যটকের নিরাপত্তা দেওয়ার কাজ। ফলে ঝুঁকিপূর্ণ সৈকতে গোসল করতে গিয়ে পর্যটকদের মৃত্যুর তালিকা ক্রমশ দীর্ঘ হচ্ছে। কক্সবাজার, ইনানী ও সেন্টমার্টিন সৈকতে গোসল করতে নেমে গত ১০ বছরে মারা গেছেন দুই শতাধিক পর্যটক। অন্যদিকে, একটু বৃষ্টিতেই সড়কের জলাবদ্ধতায় বিপাকে পড়ছেন পর্যটকরা।

পাঁচ বছর আগে সেন্টমার্টিন দ্বীপের সৈকতে পানিতে ডুবে এক দিনেই মারা যান আহ্‌ছানউল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয় শিক্ষার্থী। এর পর সৈকতে নিরাপত্তা বেষ্টনী নির্মাণ, আধুনিক উদ্ধার যান ক্রয়, অভিজ্ঞ ডুবুরি নিয়োগসহ নানা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা বলা হলেও কার্যত কিছুই হয়নি। কক্সবাজার থেকে সেন্টমার্টিন পর্যন্ত সমুদ্রসৈকতের ব্যবস্থাপনায় একটি কমিটি থাকলেও সৈকতের উন্নয়ন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কমিটির কোনো কার্যক্রম নেই।

পর্যটন মন্ত্রণালয় থেকে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে ‘কক্সবাজার বিচ ব্যবস্থাপনা কমিটি’ নামে এ কমিটি গঠন করা হয় ২০০৪ সালে। প্রজ্ঞাপনে কমিটিকে নির্দিষ্ট কয়েকটি দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে- সৈকতের নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, পর্যটকদের জন্য সার্বিক সুবিধাদিসহ উন্নয়ন এবং হোটেল-মোটেল জোনে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা; বিদেশি পর্যটকদের জন্য ‘এক্সক্লুসিভ জোন’ নির্ধারণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করা; সৈকতের উন্নয়নে সরকারের কাছে প্রস্তাব পেশ করা। কমিটিকে স্থানীয়ভাবে তহবিল সংগ্রহ করার ক্ষমতাও দেওয়া হয়। এই তহবিল সৈকতের উন্নয়নে ব্যয় করতে বলা হয় প্রজ্ঞাপনে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক হোটেল মালিক জানান, ২০১৮ সালে সৈকতের কিছু অংশে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করেছে ব্যবস্থাপনা কমিটি। কিন্তু এক বছর ধরে সেখানে আর বাতি জ্বলে না। সৈকতের প্রায় পুরো এলাকা রয়েছে অন্ধকারে। ফলে রাতে পর্যটকরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। কমিটির সদস্য সচিব ও পর্যটন করপোরেশনের ব্যবস্থাপক মীর মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সমুদ্রের ভাঙনে সৈকতে বিদ্যুতের কিছু খুঁটি উপড়ে পড়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তারও। বিদ্যুৎ লাইন মেরামতে সংশ্নিষ্ট দপ্তরকে বলা হয়েছে। তিনি আরও জানান, বিদ্যুৎ খুঁঁটির ১২৮টি বাল্ক্বের প্রায় সবই নষ্ট হয়ে গেছে। এই বাল্ক্ব কেনার জন্য ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। দ্রুতই তা কেনা হবে। সি নেটিংসহ সৈকতে অন্য কোনো উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন বিষয়ে কমিটির সদস্য সচিব বলেন, সরকারি অর্থ বরাদ্দ ছাড়া বড় কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।

সৈকত-সংশ্নিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বিচ ব্যবস্থাপনা কমিটি গত ১৬ বছরে কক্সবাজার সৈকতের উন্নয়নে কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে পারেনি। তবে সৈকতকে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করে বিভিন্ন উৎস থেকে নিয়মিত অর্থ আদায় করে যাচ্ছে। এই অর্থ আদায় হয়েছে সৈকতে ভ্রাম্যমাণ হকার, ‘কিটকট’ ব্যবসায়ী, ফটোগ্রাফার, বিভিন্ন ইভেন্ট, কনসার্টের আয়োজন, অনুদানসহ নানা উৎস থেকে।

পিপলস এনভায়রনমেন্ট ফোরামের দেওয়া তথ্যমতে, কক্সবাজার সৈকতে গোসল করতে নেমে গত এক দশকে দুই শতাধিক পর্যটকের প্রাণহানি ঘটেছে। সৈকতের উদ্ধারকর্মী মো. আলমগীর জানান, ঝুঁকি নিয়েই সমুদ্রে গোসল করতে নামেন পর্যটকরা। কিছুতেই তাদের ঠেকানো যাচ্ছে না। মাত্র কয়েকজন উদ্ধারকর্মী দিয়ে বিশাল সৈকত সামলানো সম্ভব নয়। তিনি বলেন, পর্যটকদের নিরাপদ গোসলের জন্য নির্ধারিত জোন থাকলেও তার বাইরে গিয়ে গোসল করতে নেমে পড়েন তারা। স্থানীয়দের অভিযোগ, যে কয়েকজন উদ্ধারকর্মী রয়েছেন, তারা দক্ষ নন। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এবং যানবাহনও তাদের নেই। সৈকতে নেই দক্ষ কোনো ডুবুরি।

কক্সবাজার হোটেল-মোটেল গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কাসেম জানান, সৈকতে পানিতে ডুবে প্রতি বছর পর্যটকের মৃত্যুর ঘটনায় এই শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। পর্যটকদের সচেতন করতে নানা পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজনীয় সরঞ্জামসহ দক্ষ উদ্ধারকর্মীর সংখ্যা বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, কক্সবাজারে পর্যটনশিল্প উন্নয়নে এক্সক্লুসিভ ট্যুরিস্ট জোনসহ বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা বলা হলেও তার কোনোটির কাজ শুরু হয়নি। এখনও শেষ হয়নি রেললাইন সম্প্রসারণ ও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর প্রকল্পের কাজ। সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত নাজুক। মহাসড়কের কাজ কখন শুরু হবে তা এখনও অনিশ্চিত। কক্সবাজার শহরের সড়কগুলোরও বেহাল দশা।

বেহাল সড়ক, জলাবদ্ধতা, পর্যটক ও নগরবাসীর দুর্ভোগ :গত মঙ্গল ও বুধবার দু’দিনের মাঝারি বৃষ্টিতেই তলিয়ে গেছে পর্যটননগরী কক্সবাজারের অধিকাংশ এলাকা। পর্যটকদের জন্য অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান কলাতলী এলাকাতেও থই থই পানি। প্রায় সব সড়ক পানির নিচে। সেই পানি উপচে পড়ছে সৈকতের তীর দিয়ে। পানির ধাক্কায় বালু সরে গিয়ে সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে তৈরি হয়েছে খাল। এই খাল দিয়ে জোয়ারের পানি এসে সমুদ্রগর্ভে বিলীন হচ্ছে বিস্তীর্ণ সৈকতভূমি।

কক্সবাজার শহরের প্রায় সব সড়ক গর্ত ও খানাখন্দে ভরা। পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় বেহাল এই সড়কে যান ও মানুষ চলাচলের উপায় থাকে না। প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার সম্মুখীন হচ্ছেন তারা। ঢাকার মধুবাগ থেকে স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে বেড়াতে এসেছেন জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বলেন, বৃষ্টিতে শহরের সব সড়ক তলিয়ে গেছে। সড়কে বিশাল সব গর্ত, কোথাও উন্মুক্ত নালা-নর্দমা। দু’দিন ধরে এক প্রকার হোটেলেই সময় কাটাচ্ছি।

সিলেট থেকে বেড়াতে আসা প্রকৌশলী আহসানুল হক বলেন, ‘সমুদ্রের টানে প্রায় প্রতি বছর কক্সবাজার বেড়াতে আসি। কিন্তু শহরের অবস্থা দেখলে মন খারাপ হয়ে যায়। আগে স্বাস্থ্যকর স্থান হিসেবে খ্যাতি ছিল কক্সবাজারের। এখন এটি অস্বাস্থ্যকর এক নগরী। সর্বত্র লোকজনে গিজগিজ করছে। রাস্তাজুড়ে তীব্র যানজট। রিকশা, অটোরিকশা ও নানা যানবাহন চলাচলে হাঁটারও উপায় নেই।’

কক্সবাজার শহরের বেহাল সড়ক নিয়ে কিছুটা আশার বাণী শুনিয়েছেন পৌর মেয়র মুজিবুর রহমান। তিনি বলেন, ১৩৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ২৯টি সড়ক ও উপসড়কের সংস্কার কাজ শুরু হয়েছে। ১৩০ কোটি টাকা ব্যয় বরাদ্দে আরও ১১টি বড় সড়কের টেন্ডার প্রক্রিয়া চলমান। সড়কগুলোর কাজ শেষ হলে শহরের চেহারা বদলে যাবে।

শহরের প্রধান সড়কটির একটি অংশের মেরামত কাজ শুরু করেছে সড়ক বিভাগ। লাবণী পয়েন্ট থেকে লিংক রোড পর্যন্ত সড়কটি দুই লেনে উন্নীত করা হচ্ছে। তবে প্রধান সড়কের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলিডে মোড় থেকে বাস টার্মিনাল পর্যন্ত অংশের সংস্কার কাজ কখন শুরু হবে, এখনও অনিশ্চিত। এ অংশের দায়িত্ব নিয়েছে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ।

কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান লে. কর্নেল (অব.) ফোরকান আহমদ বলেন, ২৯৪ কোটি টাকা বরাদ্দে প্রধান সড়কের হলিডে মোড় থেকে বাস টার্মিনাল পর্যন্ত অংশ নির্মাণ প্রকল্প একনেকে পাস হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে কিছু প্রক্রিয়া শেষ হলে শিগগিরই এ প্রকল্পের কাজ শুরু করা হবে।

মেরিনড্রাইভে সুফল পাচ্ছেন না পর্যটকরা: সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত ১২০ কিলোমিটার মেরিন ড্রাইভ সড়ক তৈরি হলেও এর সুফল পর্যটকরা পুরোপুরি পাচ্ছেন না। কক্সবাজার শহরের কলাতলীতে এক কিলোমিটার অংশ সমুদ্রে ভেঙে গেছে। এটি মেরামতের কোনো উদ্যোগ নেই। বিকল্প হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে কলাতলী গ্রামের মধ্য দিয়ে একটি সরু গলি। ফলে এই অংশে তীব্র যানজটে পর্যটকদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকতে হয়। মেরিন ড্রাইভের রেজু খালের ওপর সেতু নির্মিত না হওয়ায় পুরাতন সেতু দিয়ে ভারী কোনো যানবাহন চলাচল করতে পারে না। ফলে এই সড়ক পুরোপুরি ব্যবহার এখনও অনিশ্চিত।